জঙ্গলের পাসের ভুতুড়ে তালগাছ।
###ভুতুড়ে তালগাছ
গভীর জঙ্গলের প্রান্তে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল, নাম তার আন্ধারিপুর। এই গ্রামের এক প্রান্তে বিশাল একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে ছিল, যেনো গ্রামের প্রহরী। তালগাছটি এত উঁচু যে এর শীর্ষ পর্যন্ত পৌঁছানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রামের বয়স্করা বলত, এই তালগাছের নীচে নাকি রাতে ভুতের আসর বসে। দিনের বেলা তালগাছটি যেনো একেবারে নির্দোষ, নীরব সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে, চারপাশে যখন গা ছমছমে অন্ধকার নেমে আসে, তখন তালগাছটি নাকি জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তার পাতা ও ডালপালা থেকে শুরু হয় ভৌতিক কান্ড।
গ্রামের লোকেরা দিনের বেলায় তালগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সাহস করলেও, রাত হলে কেউ আর তার ধারে-কাছে ঘেঁষত না। সন্ধ্যা নামতেই চারপাশের জঙ্গল থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যেত, যেন কারা নিঃশব্দে পায়ে হেঁটে তালগাছের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিশে যেত একটি হালকা হাসির সুর। কারও কারও মতে, তা ছিল এক নারী ভুতের হাসি, যার আত্মা নাকি তালগাছের আশেপাশে ঘোরাফেরা করত।
অনেক দিন আগে এই গ্রামে কনকলতা নামে এক মেয়ে থাকত। সে ছিল খুব সুন্দরী, কিন্তু তার ভাগ্য ছিল দুঃখময়। কনকলতার বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক দূর গ্রামের এক ধনী পরিবারের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগের রাতে, কনকলতা আচমকা নিখোঁজ হয়ে যায়। সারা গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়, কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষ বলাবলি করতে থাকে যে কনকলতাকে নাকি জঙ্গলের তালগাছের নিচে দেখা গেছে, তার পরের দিন থেকেই কেউ তালগাছের আশেপাশে যাওয়ার সাহস করত না।
কথিত আছে, কনকলতার আত্মা শান্তি পায়নি, তাই সে এখন ভুত হয়ে সেই তালগাছের আশেপাশে ঘোরে। রাতে তালগাছের কাছে গেলে তার সাদা শাড়ির ছায়া দেখা যায়, আর মাঝে মাঝে শোনা যায় তার করুণ কণ্ঠস্বর। কেউ কেউ বলে, কনকলতার আত্মা নাকি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তার বিয়ে হয়নি, তার জীবনে সুখ আসেনি—এই হতাশায় সে যেকোনো তরুণীকে ধরে নিয়ে যায়।
এইসব কাহিনি শুনে গ্রামের মানুষ বেশ আতঙ্কিত ছিল। কেউই তালগাছের আশেপাশে যেতে চাইত না। তবে গ্রামের এক যুবক, নাম তার বীরু, এসব কাহিনিতে বিশ্বাস করত না। সে খুব সাহসী ছিল এবং অলৌকিক কিছুর উপর তার কোনো আস্থা ছিল না। বীরু তালগাছের নিচে রাত কাটানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামের বয়স্করা তাকে নিষেধ করেছিল, কিন্তু সে কারো কথায় কান দেয়নি। সে বলল, "আমার কিছু হবে না। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না। কাল আমি তোমাদের দেখিয়ে দেব যে এইসব গল্প সব মিথ্যে।"
রাত হলে, বীরু একটি লণ্ঠন নিয়ে তালগাছের নিচে এসে বসল। চারপাশে গভীর অন্ধকার, শুধু তার লণ্ঠনের ম্লান আলো। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে রাতের পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর বনের মধ্যে বাতাসে পাতাগুলির ঝিরঝির শব্দ হচ্ছিল। বীরু গাছের নিচে বসে ভাবছিল, "কোথায় সেই ভূত? সবই তো মিথ্যে।" কিন্তু তার এই আত্মবিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হলো না।
রাত বাড়তে থাকল। হঠাৎ করে বাতাসে শীতলতা অনুভব করল বীরু। তার মনে হলো, কোনো অজানা কারণে তালগাছের পাতা অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। সেই সঙ্গে দূরে থেকে আসা একটি সুর—মৃদু হাসির শব্দ। বীরু প্রথমে পাত্তা দিল না, কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল। তালগাছের উপর থেকে যেন কারো সাদা ছায়া নেমে আসছে। বীরু কাঁপতে শুরু করল, তার বুকের ভেতর ধুকধুকানি বাড়তে লাগল।
সে লণ্ঠনের আলো বাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বাতাসের ঝাপটায় লণ্ঠনটি নিভে গেল। চারপাশে ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হঠাৎ করে কনকলতার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, "তুমি কেন এসেছো এখানে? তুমি কি জানো না, এই গাছের নিচে মৃত্যু ঘুরে বেড়ায়?"
বীরুর শ্বাস আটকে গেল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে পালাতে চাইল, কিন্তু পা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। তার চারপাশে অদ্ভুত হিমশীতলতা ঘিরে ধরল। তখন সে একটি সাদা ছায়া দেখতে পেল, ঠিক তার সামনে। সেই ছায়াটি যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। কনকলতার আত্মা, তার চোখে বিষণ্ণতা আর প্রতিশোধের ছায়া। "তুমি আমাকে মুক্তি দিতে এসেছ?" আত্মাটি মৃদু স্বরে বলল।
বীরু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "কে তুমি? তুমি কি কনকলতা?"
অতৃপ্ত আত্মা গভীর শ্বাস নিল, "হ্যাঁ, আমি কনকলতা। আমার জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমি শান্তি পাইনি। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমাকে মুক্তি দাও।"
বীরুর হৃৎপিণ্ড তখন এত জোরে ধুকধুক করছিল, মনে হচ্ছিল সে আর বাঁচবে না। তার মনে হলো, তালগাছের পাতা, বাতাসের শব্দ, আর সেই আত্মার উপস্থিতি একসঙ্গে মিলে যেন তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। সে প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু শব্দ তার মুখ থেকে বের হলো না। তার চারপাশে কালো ছায়াগুলি নাচছিল, আর সেই হাসির সুর আরও তীব্র হয়ে উঠছিল।
তবে হঠাৎ করেই তালগাছের মাথায় আলো জ্বলে উঠল। আকাশ থেকে যেন একটি তীব্র ঝলকানি নেমে এলো। সেই আলোর স্পর্শে কনকলতার আত্মা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। বীরু মাটিতে পড়ে গেল, অবচেতন অবস্থায়। সকালে গ্রামের লোকেরা তাকে অচেতন অবস্থায় তালগাছের নিচে খুঁজে পেল। তাকে যখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো, সে একটানা কাঁপছিল আর বলছিল, "আমি ভূত দেখেছি, আমি কনকলতাকে দেখেছি।"
গ্রামের লোকেরা এরপর থেকে সেই তালগাছের কাছাকাছি আর যায় না। তবে একদিন গ্রামের পুরোহিত এসে তালগাছের নীচে পূজা করে, কনকলতার আত্মাকে শান্তি দেয়ার চেষ্টা করলেন। কনকলতার আত্মা কি মুক্তি পেল, তা কেউ জানে না। তবে রাতের অন্ধকারে এখনও মাঝে মাঝে সেই তালগাছের পাতা অস্বাভাবিকভাবে নড়ে ওঠে, আর দূর থেকে ভেসে আসে এক করুণ সুর—যেন কেউ মুক্তির অপেক্ষায়।
Comments
Post a Comment