নদীর পাড়ের ভুতুড়ে শেওড়া গাছ
**নদীর পাড়ের ভুতুড়ে শ্যাওড়া গাছ**
পূর্ব বাংলার এক নিস্তব্ধ গ্রাম। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি গভীর নদী। নদীর নাম কীর্তিনদী। তার জলের স্রোত সারা বছরই প্রবাহিত, তবে বর্ষায় তা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এই নদীর পাড়েই বিশাল একটি শ্যাওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটি কত পুরনো, তার সঠিক হিসেব গ্রামের কারও জানা নেই। তবে গ্রামের প্রাচীনতম মানুষরাও ছোটবেলায় গাছটিকে একই রকম দেখেছেন। সে যেন চিরকাল এই নদীর পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে।
গাছটি সম্পর্কে গ্রামে এক অদ্ভুত বিশ্বাস আছে—তাতে ভূত থাকে। দিনের বেলায় গাছটি সাধারণের মতই লাগে, তবে রাতের বেলায় এর চেহারা পুরোপুরি বদলে যায়। গাছের পাতাগুলো তখন যেন নিঃশব্দে কাঁপতে থাকে, শাখাগুলো যেন নিজে থেকে নড়ে ওঠে। বাতাস না থাকলেও পাতার কাঁপন শুনে মনে হবে যেন কেউ ওদের স্পর্শ করে যাচ্ছে।
যারা কীর্তিনদীর পাড়ের এই গাছের কাছ দিয়ে রাতের বেলা গেছেন, তারা কেউ আর স্বাভাবিক থাকেননি। কেউ পাগল হয়েছেন, কেউ হারিয়ে গেছেন, আবার কেউ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এরকমই এক ঘটনা ঘটেছিল গ্রামের রবি নামের এক যুবকের সাথে।
রবি ছিল গ্রামের সবচেয়ে সাহসী যুবক। তার জীবনে ভয় বলে কিছু ছিল না। শ্যাওড়া গাছ নিয়ে গ্রামের মানুষদের কুসংস্কারগুলোকে সে নিছকই বাজে গুজব বলে মনে করত। তার বাবা-মা বহুবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “শ্যাওড়া গাছের কাছে যাস না, রাতে তো একদমই না।” তবে সে সেসব কথায় কান দেয়নি।
একদিন সন্ধ্যায় রবি তার বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল। সে নদীর পাড়ের পথ ধরেছিল কারণ সেখান দিয়ে ফেরা ছিল বেশ সহজ। রাত তখন বেশ গভীর, আকাশে মেঘের ছায়া আর নদীর স্রোত মৃদু গর্জন তুলছিল। চারপাশ অন্ধকার, শুধু জোনাকির ক্ষীণ আলো।
গাছের কাছাকাছি আসতেই রবি কিছু অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে সে পাত্তা দিল না, ভাবল হয়তো নদীর পাড়ের কোনও প্রাণী হবে। কিন্তু শব্দটা একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠল। যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। রবি তখন গাছটার দিকে তাকাল। তার বুকের ভেতর একটু অস্বস্তি শুরু হল, তবে সে নিজেকে সাহসী মনে করে গাছের দিকে এগিয়ে গেল।
গাছের নিচে এসে দাঁড়াতেই সে দেখল অন্ধকারের মধ্যেও গাছের শাখাগুলো অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। তার মনে হল, বাতাস নেই, তবে গাছ কেন এভাবে দুলছে? হঠাৎই গাছের এক মোটা শাখা রবির সামনে এসে থেমে গেল, যেন সেটা তাকে ডাকছে। সে থমকে দাঁড়াল।
এমন সময় হঠাৎ করেই রবির সামনে আবছা ধোঁয়ার মত কিছু একটা দেখা দিল। প্রথমে সেটা স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু ধীরে ধীরে রবির চোখের সামনে একটা নারী অবয়ব ফুটে উঠল। কুয়াশার মতো সাদা পোশাক পরা সেই নারীকে দেখে রবির শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এ কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। কিন্তু এতক্ষণ ধরে সাহস দেখানো রবি এক মুহূর্তে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। নারীর চোখগুলো আগুনের মত জ্বলজ্বল করছিল। তার ঠোঁটের কোণে ছিল অদ্ভুত এক হাসি—একটা বিদ্রুপ আর ভয় মেশানো হাসি। সেই হাসি যেন রবির রক্ত ঠান্ডা করে দিল। নারীর হাত দুটো ধীরে ধীরে তার দিকে বাড়তে থাকল। রবি চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলার স্বর হারিয়ে ফেলল।
গাছের পাতার ফিসফিসানি, নদীর স্রোতের গর্জন, আর সেই নারীর শীতল উপস্থিতি মিলে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করল। রবি পেছন ফিরে দৌড়াতে গিয়েও পা নাড়াতে পারল না। নারীর ঠান্ডা হাত তার কাঁধে পড়তেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
সকালে গ্রামের লোকেরা রবিকে নদীর পাড়ে পড়ে থাকতে দেখল। তাকে দ্রুত বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু সে আর কখনও স্বাভাবিক হতে পারল না। সে শুধু ঘরের কোণে বসে ফিসফিস করে কথা বলত, কখনও হাসত, কখনও কাঁদত। তার মা-বাবা অনেক ওঝা-ফকির দেখালেন, কিন্তু কেউই তাকে সুস্থ করতে পারল না। রবি আজও জীবিত, কিন্তু তার মনের গভীরে সেই নারীর ভয়াবহ উপস্থিতি গেঁথে আছে।
এই ঘটনার পর থেকে গ্রামের লোকেরা শ্যাওড়া গাছের পাড় মাড়াতে আরও সতর্ক হয়ে গেল। রাতের বেলা কেউ আর নদীর পাড়ে যেতে সাহস পায় না। শোনা যায়, সেই গাছের নিচে আরও অনেক আত্মা বন্দি আছে। তাদের কেউ কেউ এখনও মুক্তির অপেক্ষায়, আর কেউ কেউ নদীর পাড়ে নতুন শিকার খুঁজছে।
তবে কি সেই গাছের ইতিহাসে কোনও অন্ধকার অধ্যায় ছিল? গ্রামের বৃদ্ধ মহিষী কাকা একদিন একটি গল্প বলেছিলেন। কয়েক শতাব্দী আগে এই নদীর পাড়ে এক রাজা রাজত্ব করতেন। তার নাম ছিল রাজা বিক্রমসেন। তার ছিল এক অদ্ভুত শখ—তন্ত্রমন্ত্র আর কালো জাদু। তিনি বহুবার এই শ্যাওড়া গাছের নিচে তন্ত্রসাধনা করেছেন। শোনা যায়, একদিন তার এক প্রিয় রানী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। শোকে পাগল রাজা রানীর আত্মাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তন্ত্রমন্ত্র শুরু করেন। সেই রাতে তিনি গাছের নিচে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। কিন্তু কিছু একটা ভুল করে ফেলেন। রানীর আত্মা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে সেখানে বহু অশুভ শক্তি জেগে ওঠে। রাজা তার সাধনা শেষ করার আগেই সেই আত্মাগুলি তাকে আক্রমণ করে এবং তাকে মেরে ফেলে। রাজা বিক্রমসেনের আত্মা আজও মুক্তি পায়নি, আর তার রানীর আত্মা সেই গাছের নিচে বন্দি হয়ে আছে।
গ্রামের বৃদ্ধারা এখনো বলেন, সেই শ্যাওড়া গাছটা অভিশপ্ত। তার তলায় যারা যায়, তারা আর ফিরে আসে না। কারণ সেই গাছ শুধু একটি নয়, অনেক আত্মার কারাগার। গ্রামের লোকেরা এখনও রাতের বেলায় নদীর পাড় মাড়ায় না, কারণ তারা জানে—কীর্তিনদীর পাড়ের সেই শ্যাওড়া গাছ এখনও জীবন্ত, এখনও তার শাখায় বন্দি আত্মারা মুক্তির আশায় ফিসফিস করে।
Comments
Post a Comment