তেতুল তলার ভুত
### তেতুল তলার ভূত
গাঁয়ের নাম কাশীপুর। সময়টা রাতের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া এক শীতল সন্ধ্যা। পূর্ণিমার আলোয় ঢেকে থাকা গাঁয়ের পথে সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাঁয়ের মানুষগুলো দিনের শেষে ঘরে ফিরে গিয়েছে। সব কিছু যেন থমকে গেছে। কিন্তু এই নীরবতার মধ্যে এক জায়গা, যেখানে পা রাখার সাহস কারো নেই—তেতুল তলা।
তেতুল গাছটা বিশাল। বয়স প্রায় একশো বছরের বেশি হবে। গাছটার নিচে একটা পুরনো পাথরের বেদী, যা দেখে মনে হয় কোনো পুরনো মন্দিরের অংশ ছিল এককালে। গাঁয়ের বয়স্করা বলেন, এই গাছটা অভিশপ্ত। রাত হলে তেতুল তলার ভূতের আনাগোনা শুরু হয়। অনেকেই বলেছে, রাতে সেখানে গেলে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়, যেন কেউ গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ বলেছে, গাছের তলায় বসে হঠাৎ কারো নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পেয়েছে, কিন্তু কাছেপিঠে কেউ ছিল না।
কিছুদিন আগে গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত গোপাল ঠাকুরের ছেলে কালীচরণ রাতের বেলা তেতুল তলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, কিন্তু সাহস করে গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে গেল সে। কালীচরণ বেশ সাহসী ছেলে, ভূতের গল্পে তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। হঠাৎই সে দেখল, গাছের ডাল থেকে নিচে কিছু একটা নেমে আসছে, সাদা ধবধবে কাপড় পরা, যেন কোনো পুরনো দিনের মানুষ। কালীচরণ ভয় পেয়ে এক দৌড় দিল, গাঁয়ের পাড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর থেকে সে আর আগের মতো স্বাভাবিক নেই, সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ঠিকমতো উত্তর দেয় না।
এ ঘটনাটা গ্রামের মানুষদের মনে তেতুল তলার ভূতের গল্পের সত্যতার ধারণা আরও দৃঢ় করে দেয়। গাঁয়ের প্রবীণ লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরনো কাহিনি। বছর পঞ্চাশেক আগে, কাশীপুর গ্রামের জমিদার হরিপদ রায়, অত্যন্ত কঠোর শাসক ছিলেন। গাঁয়ের লোকজনকে নানান অত্যাচারে জর্জরিত করতেন। ট্যাক্স দিতে দেরি হলে বেত্রাঘাত করতেন, গরিব কৃষকদের জমি কেড়ে নিতেন। তার এই অত্যাচারের শিকার হয়েছিল রামধনু নামে এক চাষি। জমিদার তার জমি কেড়ে নিয়ে তাকে ন্যূনতম মজুরিতেও চাকরি করতে বাধ্য করেছিলেন।
রামধনুর পরিবার তখন অত্যন্ত কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। একদিন টাকার অভাবে তার ছোট ছেলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। রামধনু একাই জমিদারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন, কিন্তু জমিদার কোনো সহানুভূতি দেখাল না। অসহায়ের মতো রামধনু বাড়ি ফিরল, আর তার ছেলেটি সেদিনই মারা গেল। তার পরদিনই রামধনু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন সেই তেতুল তলায়।
শোনা যায়, সেই ঘটনার পর থেকেই তেতুল তলায় ভূতের আনাগোনা শুরু হয়। কেউ বলে রামধনুর আত্মা এখনো প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে, জমিদারের প্রতি তার ক্ষোভ এতটাই গভীর যে, তার মৃত্যুর পরও শান্তি পায়নি। আবার কেউ কেউ বলে, জমিদার হরিপদ রায়ও একসময় এক অদ্ভুত রোগে ভুগে মারা যান। গাঁয়ের লোকেরা বলত, এ তার শাস্তি ছিল, রামধনুর অভিশাপেই এমনটা ঘটেছিল।
তবে এ কাহিনি শুধু গল্প বলে মনে হতো যদি না আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটত।
একদিন গ্রামের নতুন স্কুল মাস্টার, তরুণ বয়সী সুনীল বাবু, ভূতের গল্প শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “আমি কাল তেতুল তলায় গিয়ে প্রমাণ করে দেব, এ সব বাজে কথা। কোনো ভূতটুত নেই।” গাঁয়ের লোকজন তাঁকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি শোনেননি।
রাত হল। সুনীল বাবু কাঁধে একটা লণ্ঠন নিয়ে তেতুল তলার দিকে রওনা দিলেন। সঙ্গে কয়েকজন যুবকও গেল, কিন্তু গাছের কিছু দূরে দাঁড়িয়েই তারা থেমে গেল, আর সাহস করে এগোল না। সুনীল বাবু গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি লণ্ঠনটা গাছের ডালে তুলে দিলেন, চারদিকে তাকালেন—সব শান্ত, নিঃশব্দ। হঠাৎ করেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে তাঁর শরীর শিরশিরিয়ে দিল। এক মুহূর্তে সব যেন স্থির হয়ে গেল।
সুনীল বাবু গাছের নিচে বসে পড়লেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, কেউ যেন পেছন থেকে তাঁকে ডাকছে, “বাবু… বাবু…”। তিনি পেছনে ফিরে তাকালেন, কিন্তু কেউ নেই। এক অজানা ভয় তাঁকে গ্রাস করল। তিনি লণ্ঠনটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তখনই অনুভব করলেন, গাছের ওপর থেকে কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
তিনি দ্রুত পা চালালেন, কিন্তু পেছন থেকে সেই ডাক ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠল। ভয়ানক ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছিল। কোনো রকমে দৌড়ে গ্রামে ফিরে এলেন সুনীল বাবু। কিন্তু সেদিন থেকেই তিনি আর কথাবার্তা বলেন না, সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে নিজেকে বন্দি করে রাখেন।
তেতুল তলার ভূতের গল্পটা এরপর থেকে কাশীপুরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। রাত হলে কেউ আর সেই গাছের ধারে-কাছেও যায় না। ধীরে ধীরে গাছটা আরও পুরনো হয়ে পড়ল, কিন্তু ভূতের ভয় থেকে গেল। তেতুল তলার গাছটা দাঁড়িয়ে রইল, আর তার নিচে যেন চাপা পড়ে রইল অনেক রহস্য, অনেক ভয়ানক কাহিনি।
Comments
Post a Comment