ভুতুড়ে জমিদার বাড়ি

 ###ভুতুড়ে জমিদার বাড়ি 

একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, নাম তার সাতকানিয়া। চারপাশে গাছগাছালি আর ছোট ছোট পুকুরে ভরা, যেন প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক শীতল স্থান। এই গ্রামেই দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি—দূর থেকে দেখলে মনে হবে সময়ের সাথে লড়াই করে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃসঙ্গ আত্মা। বাড়িটির নাম ‘রায়চৌধুরী বাড়ি’। স্থানীয়দের কাছে এটি শুধুই এক প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ নয়; এটি রূপকথার রহস্য আর ভূতের গল্পের প্রতীক।


রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস এ বাড়ির দেয়ালগুলোর গায়ে এখনো আঁকা আছে। একসময় এই পরিবারের ছিল অগাধ সম্পদ ও ক্ষমতা। জমিদারি শাসনকালে তারা শাসন করত সাতকানিয়া সহ আশেপাশের গ্রামগুলো। তবে জমিদারের অমর্যাদা, অত্যাচার ও পৈশাচিক স্বভাবের কারণে তাদের পতন ঘটেছিল হঠাৎ করেই। শেষ জমিদার ছিলেন রাজনারায়ণ রায়চৌধুরী, যিনি প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ছিলেন। গ্রামের মানুষদের উপর তাঁর অত্যাচারের কোনো সীমা ছিল না। শোনা যায়, এক রাতে গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি জমিদারকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। তারা সবাই মিলে জমিদারবাড়িতে ঢুকে রাজনারায়ণকে হত্যা করেছিল। জমিদারবাড়ির প্রাচুর্যের অবসান ঘটল সেই রাতেই।


এরপর থেকে বাড়িটি খালি পড়ে থাকে। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে বাড়ির দেয়াল, ছাদ থেকে চুন খসে পড়তে থাকে, এবং চারপাশের ঝোপঝাড় বাড়িটিকে গ্রাস করে নেয়। তবে স্থানীয় লোকেরা বলে, সেই রাতের পর জমিদার রাজনারায়ণের আত্মা আজও ফিরে আসেনি; বরং সেই বাড়ির মধ্যে আটকা পড়েছে। বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত, তবে রাতে কেউ তার আশপাশ দিয়ে যেতে সাহস করে না। বলা হয়, রাত গভীর হলে বাড়ির ভেতর থেকে এক অশরীরী কণ্ঠ শোনা যায়, জমিদারের প্রতিশোধের আহ্বান।


একদিন, শহর থেকে আসা একদল পর্যটক এই বাড়ির গল্প শুনে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তাদের মধ্যে ছিল নীলয়, মীরা, অভি এবং তৃষা। তারা সবাই ছিল অত্যন্ত উৎসাহী এবং ভূতের গল্পে বিশ্বাস করত না। গ্রামবাসীরা তাদের বারবার সাবধান করেছিল, কিন্তু তারা কারও কথায় কান দিল না। বরং তারা সন্ধ্যার পরই জমিদারবাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে রাতের অন্ধকারে তারা সেই বাড়ির রহস্য অনুভব করতে পারে।


সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই তারা বাড়ির দিকে রওনা দেয়। চারপাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে তারা যখন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায়, তখনই এক অদ্ভুত শীতল হাওয়া তাদের গায়ে এসে লাগে। বাড়িটি সামনে দাঁড়িয়ে, যেন এক কালের সাক্ষী হয়ে বসে আছে। বাড়ির প্রধান দরজা খোলা ছিল না, তবে ভাঙা জানালাগুলো দিয়ে সহজেই ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল।


তারা জানালা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। ভেতরে সবকিছুই ধুলোমাখা, বাতাসে ভেসে আসা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। ঘরগুলো খালি, তবে একটি অদ্ভুত চাপা শব্দ শুনতে পায় তারা, যেন দূর থেকে কেউ কান্না করছে। নীলয় বলল, “এটা নিশ্চয়ই বাতাসের শব্দ।” কিন্তু তৃষা ঠিকমতো হাঁটতে পারছিল না, সে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল কেউ তাদের দেখছে, অনুসরণ করছে। মীরা তাকে সাহস দিয়ে বলে, “ভয়ের কিছু নেই, এগুলো আমাদের মনের ভুল।“


কিছুক্ষণ পর তারা মূল হলঘরে পৌঁছায়। এটি ছিল জমিদারের প্রিয় স্থান, যেখানে তিনি বসে বিচার করতেন। এখানে এসে তারা আশ্চর্যজনকভাবে একটি বড় ঝাড়বাতি দেখতে পায়, যা সময়ের ক্ষয়েও অক্ষত ছিল। হঠাৎ ঝাড়বাতিটি নড়তে শুরু করে, এক অশরীরী বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় তাদের। মীরা চিৎকার করে উঠে, “এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা তো এখানে কেউ হাতও দিইনি!” অভি কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে এলো এক গভীর পুরুষ কণ্ঠ—“কেউ আমার ঘর থেকে যাবে না।”


সবার শরীর শিউরে উঠল। কণ্ঠটা যেন ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল। নীলয় সাহস করে বলে, “ক...কে আছো? আমরা কেউ তোমার ক্ষতি করতে আসিনি।”


হঠাৎ, ঝাড়বাতির সব আলো নিভে গেল, আর চারদিকে ছেয়ে গেল অন্ধকার। তাদের মনে হলো যেন জমিদারের আত্মা তাদের ঘিরে ধরেছে। তারা একসাথে চিৎকার করতে থাকে এবং বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দরজাগুলো আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। তৃষা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানালার দিকে দৌড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা যেন মাটিতে আটকে গেল।


“আমরা এখানে আসা ভুল করেছি,” নীলয় বলল। “এটা কোনো সাধারণ পরিত্যক্ত বাড়ি নয়।”


কণ্ঠটি আবার শোনা গেল—“আমি আমার প্রতিশোধ চাই, তোমরা কেউ এখানে থেকে বাঁচবে না।”


তৃষা আতঙ্কিত হয়ে এক কোণে বসে পড়ে, আর মীরা তাকে ধরে ফেলে। তারা সবাই বুঝতে পারে যে এখন শুধু নিজেদের মধ্যে সাহস ও একতা থাকলেই তারা এই জায়গা থেকে বের হতে পারবে। অভি মোমবাতি বের করে জ্বালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু বাতাসের তীব্রতা এত বেশি যে তা বারবার নিভে যায়।


এদিকে তৃষা চোখ মেলতে মেলতে দেখে, হলঘরের মধ্যেই এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে পুরানো রাজকীয় পোশাক, মাথায় পাগড়ি, আর তার চোখ দুটো রক্তবর্ণে জ্বলজ্বল করছে। সে বুঝতে পারে, এটাই সেই জমিদার রাজনারায়ণের আত্মা। আতঙ্কে সে কিছু বলতে পারে না, তার গলা শুকিয়ে যায়।


আত্মাটি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে, আর তার হাতের দিকে ইশারা করে বলে, “তোমাদের আত্মা এখন আমার!”


ঠিক সেই মুহূর্তে, নীলয় নিজেকে সামলে নিয়ে জানালার এক কোণ থেকে একটি লোহার রড খুঁজে পায়। সে তা হাতে নিয়ে আত্মার দিকে ইশারা করে বলে, “তুমি আমাদের কিছু করতে পারবে না!”


আত্মাটি হঠাৎ থমকে যায়। কিন্তু সে আবার চিৎকার করে উঠে, “আমার প্রতিশোধ কেউ থামাতে পারবে না!”


মীরা আচমকা বলে উঠে, “তোমার মৃত্যুর কারণ আমরা নই। আমাদের কোনো দোষ নেই, আমাদের ছেড়ে দাও।”


কিছুক্ষণ থেমে যায় চারপাশের সবকিছু। আত্মার চোখ যেন এক মুহূর্তের জন্য কোমল হয়ে আসে। সে ধীরে ধীরে বলে, “তোমরা যদি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারো, তবে আমি তোমাদের ছেড়ে দেব।”


তৃষা অসহায়ভাবে বলে, “কীভাবে? দরজা তো বন্ধ।”


আত্মাটি নিঃশব্দে হাত তুলে দরজার দিকে ইশারা করল, আর দরজাটি খুলে গেল। তারা সবাই জানত, এটা তাদের একমাত্র সুযোগ। সবাই দৌড়াতে শুরু করে দরজার দিকে। একে একে তারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে, আর একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না। জমিদার বাড়িটি আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আর সেই রাতের পর কেউ কখনো জমিদার বাড়ির কাছেও যায়নি।


এই অভিজ্ঞতার পর, নীলয়, মীরা, তৃষা এবং অভি বুঝতে পারে যে সবকিছুই মনের ভুল নয়, কিছু রহস্য সত্যিই বাস্তব। তারা আবার শহরে ফিরে যায়, কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি তাদের জীবনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। সাতকানিয়ার জমিদার বাড়ি তখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক আতঙ্কজনক ইতিহাস—যা কেউ আর ছুঁতে সাহস করে না।

Comments

Popular posts from this blog

নদীর পাড়ের ভুতুড়ে শেওড়া গাছ

তেতুল তলার ভুত